দু’একটির স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন থাকলেও ফরিদগঞ্জের বিভিন্ন হাট-বাজারের বেশির ভাগই ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে অনুমোদনহীন।

অনলাইন ডেস্ক : ফরিদগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দু’একটির অনুমোদন থাকলেও বেশির ভাগই ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে অনুমোদনহীন। স্বাস্থ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা নীতিগত ঠিক রাখা ও অবৈধভাবে এসব বাণিজ্য ঠেকাতে ২০১৮ইং সালের অক্টোবর থেকে রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত অনলাইন কার্যক্রম চালু করেছে সরকার। এ অনলাইনে দেশের সব বৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা দেয়া আছে বলে তথ্য রয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। যে কেউ অনলাইনে গিয়ে যে কোনো জেলা বা উপজেলার নাম লিখে সার্চ দিলেই দেখতে পাবেন সেখানকার অনুমোদিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নামগুলো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক ২০১৯ সালের ১ আগস্টের প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়গনস্টিক সেন্টারের তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ফরিদগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে মোট ১৬টি ডায়গনস্টিক সেন্টার রয়েছে। যেগুলোর লাইসেন্স ইতঃমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। কোনো কোনোটির লাইসেন্সের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে ২০১৬ সালেই। এর মধ্যে ৩টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্সই নেই। এগুলো হলো : রূপসা বাজারের মুনমুন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, আষ্টাবাজারের নিউ আলরাজী ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও খাজুরিয়া বাজারের লাইফ কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার।অভিযোগ রয়েছে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় চিকিৎসকদের জন্য ৪০ শতাংশ কমিশন এখন ওপেন সিক্রেট। ব্যবসায়ীরাও এটি বিবেচনায় নিয়ে বেশি বেতনের ভালো কোনো টেকনিশিয়ান রাখেন না। তাদের প্রতিষ্ঠানে সাধারণ কর্মী দিয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার কাজ সম্পন্ন করা হয়। আর তাদের তালিকাভুক্ত চিকিৎসকের সিল মেরে দেওয়া হয় রিপোর্টে। এক চিকিৎসকের দেওয়া পরীক্ষার রিপোর্ট আরেক চিকিৎসকও গ্রহণ করেন না। তিনি পুনরায় পরীক্ষা করাতে বলেন। এর নেপথ্যেও রয়েছে কমিশন বাণিজ্য। আর পৃথক ডায়াগনস্টিক সেন্টারের স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্টও আসে ভিন্ন ভিন্ন। অভিযোগ রয়েছে, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান মেয়াদোত্তীর্ণ রিএজেন্ট ব্যবহার করে ভুয়া প্যাথলজিক্যাল টেস্ট রিপোর্ট দেয়।
গবেষকরা বলছেন, মানহীন ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কারণে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ভুল রিপোর্ট চলে আসে। ওই রিপোর্ট অনুযায়ী চিকিৎসকরা ওষুধ দেন। যদি রিপোর্টে যথাযথ রোগের তথ্য উঠে না আসে, তাহলে ভিন্ন রোগের ওষুধ রোগমুক্তির বদলে নতুন জটিলতা সৃষ্টি করে। তারা জানান, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এক. ভালোমানের মেশিন। দুই. মানসম্পন্ন রাসায়নিক এবং তিন. দক্ষ টেকনিশিয়ান।
ফরিদগঞ্জে গাণিতিক হারে বেড়ে উঠছে ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও প্যাথলজি ব্যবসা। বিভিন্ন আলোকসজ্জা সাইনবোর্ড থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানে নিয়ম-নীতির বালাই নেই। হাতুড়ে টেকনিশিয়ান দ্বারাই চালানো হয় রোগ নির্ণয়ের যাবতীয় পরীক্ষা। তারা মনগড়া রিপোর্ট তৈরি করে ঠকিয়ে চলছে নিরীহ মানুষকে। একই রোগ পরীক্ষায় একেকটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে একেক রকম রিপোর্ট পাওয়ার বিস্তর নজির রয়েছে। বিলের ক্ষেত্রেও আছে সীমাহীন নিয়ন্ত্রণহীনতা। একই পরীক্ষা-নিরীক্ষা একেক ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একেক রকম বিল আদায় করে নেওয়া হচ্ছে। ডায়াগনস্টিক টেস্টের ক্ষেত্রে কোনো মানদণ্ড নিশ্চিত হচ্ছে না।
সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারসহ একশ্রেণির ডাক্তারদের সহায়তায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকদের যথেচ্ছ টেস্ট বাণিজ্য চলছে বছরের পর বছর। বেশির ভাগ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত সার্টিফিকেটধারী দক্ষ টেকনিশিয়ান নেই। প্রতারণার শিকার মানুষজন বার বার অভিযোগ তুলেও প্রতিকার পাচ্ছেন না।
জটিল-কঠিন কি সাধারণ সব রোগীর ক্ষেত্রে চিকিৎসার নামে নানা কায়দায় নানাভাবে চলছে টেস্ট বাণিজ্য। ‘যত টেস্ট ততো কমিশন’ এই সূত্রে চলছে একশ্রেণির ডাক্তারের অর্থ উপার্জনের বেপরোয়া কর্মকা-। ডাক্তারের কমিশন ছাড়া বাকি সিংহভাগই লাভ এই মূলমন্ত্র হৃদয়ে ধারণ করে যে কেউ যে কোনো স্থানে ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে বসেছে। কমিশনের জন্যে এখন ডাক্তাররা কথায় কথায় টেস্ট দিচ্ছেন। সাধারণ রোগের জন্যেও চিকিৎসকরা বিভিন্ন টেস্ট দিয়ে রোগীদের পাঠাচ্ছেন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। নিজেদের মানের চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান দাবি করে একশ্রেণির বেসরকারি হাসপাতাল রোগীদের থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। সেসব স্থানে রোগীদের রীতিমতো জিম্মি করেই ‘মুক্তিপণ’ স্টাইলে টাকা আদায় করা হয়ে থাকে। সাধারণ জ্বর বা পেট ব্যথা নিয়ে কোনো রোগী হাজির হলেও কয়েক ডজন টেস্ট, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অপারেশন করাসহ জীবন বাঁচানোর পরিবর্তে উল্টো রোগীকে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে লাইফসাপোর্টে। আর এর প্রতিটি ধাপেই চলে টাকা আদায়ের ধান্দা। টেস্টের নামে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ আদায় এখন অতি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সরকারি হাসপাতালে রোগ পরীক্ষার যন্ত্রগুলো হয় অকেজো, নয় তো খোলাই হয় না বছরের পর বছর। আবার সচল যন্ত্রপাতির সংযোজন থাকলেও তা চালানোর মতো টেকনিশিয়ান নেই সেখানে। আবার যেখানে টেকনিশিয়ান রয়েছে সেখানে নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি। থাকলেও সেগুলো বছরের পর বছর ধরে বিকল অবস্থায় ফেলে রাখা হয়েছে। এসব কারণে উপজেলা হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জামাদির সুযোগ-সুবিধা রোগীদের ভাগ্যে জুটছে না। ফলে নূ্যনতম রক্ত পরীক্ষা থেকে শুরু করে ক্যান্সার নির্ণয় পর্যন্ত যাবতীয় টেস্টের জন্য রোগীরা বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের ওপরই নির্ভরশীল হচ্ছে।
রোগী তার পছন্দের ডায়াগনস্টিক সেন্টারে টেস্ট করালে কোনো কোনো ডাক্তার সে পরীক্ষা গ্রহণ না করারও নজির রয়েছে। এ সুযোগে কথিত ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো পরীক্ষার ফি বাবদ ইচ্ছামাফিক টাকা আদায়ের মনোপলি ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে রোগীদের থেকে মাত্রাতিরিক্ত ফি আদায় কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। ফরিদগঞ্জে প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের রয়েছে তাদের সমিতি কর্তৃক অভিন্ন রেটচার্ট। তবে তাদের মনগড়া এ রেটচার্ট গোপন করে এর বাইরেও অনেকে অতিরিক্ত টাকা নিচ্ছে। রেটচার্ট টানানোর কথা থাকলেও কেউই মানছে না আদালতের এই সিদ্ধান্তকে। টেস্টের টাকা পরিশোধ করে সর্বস্বান্ত হয়ে চিকিৎসা না নিয়েই বাসায় ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির রোগীরা। আবার বেশি টাকা দিয়ে টেস্ট করিয়েও সঠিক রোগ নির্ণয়ের নিশ্চয়তা পাচ্ছে না ভুক্তভোগীরা। এসবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদফতরের দায়িত্বশীল বিভাগটি অজ্ঞাত কারণে বরাবরই চরম উদাসীন।
রোগ নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি অনুমোদন নেয়ারও প্রয়োজন বোধ করে না। কেউ কেউ লাইসেন্সের জন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে আবেদন পাঠিয়েই বড় বড় ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে বসেছেন। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রও নেয়নি এসব প্রতিষ্ঠান।
ভুক্তভোগী মুনতাসির ফরহাদ সানিম গত আগস্ট মাসে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নিয়ে ডাক্তার দেখালে ডাক্তার টেস্ট দেয়। পরদিন পরীক্ষাগুলো সেবা ডায়গনস্টিক এন্ড কনসালটেশন সেন্টারে করিয়ে উপজেলার একজন স্বনামধন্য চিকিৎসককে দেখালে তিনি পরীক্ষাগুলো বাতিল করে আবার পরীক্ষা দেন। দু্ই ঘণ্টার ব্যবধানে পরীক্ষার ফলাফল যায় পাল্টে। ২ ঘণ্টার মধ্যে সানিমের ডেঙ্গু হয়ে যায়। ডাক্তার তার প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার ফলাফলের আলোকে নাপা আর তরল খাবার ছাড়া আর কিছুই দিলেন না। ২ দিন তার অধীনে চিকিৎসা নেয়ার পর বাচ্চার অবস্থা খুবই অবনতি দেখে চাঁদপুরে নিয়ে ডাঃ মুহাম্মদ আব্দুল আজিজকে দেখালে তিনি আবার পরীক্ষা দেন। এবার আসলো ভিন্ন ধরনের ফলাফল। এবার ডাক্তার বললেন ডেঙ্গু নেই। তিনি চিকিৎসা দিলেন এবং দুই দিনের মাথায় সানিম সুস্থ হয়ে উঠলো। প্রতিদিন এ রকম বহু ঘটনা ঘটছে ফরিদগঞ্জে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *