ধূসর বেলায় মন এত পোড়ে কেন?

প্রায় ৬ দশকের কাছাকাছির মানুষ আমি। এই বয়স পর্যন্ত তেমন কোন পূর্ণের কাজ করেছি কি-না জানিনা। তবে জ্ঞাতসারে ইচ্ছাকৃত কারো তেমন ক্ষতি করেছি এমনটা মনে পড়ে না। হয়তো যা করেছি সবটাই খারাপ যা আমার মনের আয়নায় ধরা পড়েনি। গেল কয়দিন আগে পোড় খাওয়া আমার এক বন্ধু কথা প্রসঙ্গে জানতে চায় আমি জীবনে সবই কি ভাল কাজ করেছি? উত্তরে জানালাম আমার জীবনে ভালো বা সফল হবারমত কোন কাজ করেছি বলে আমার মনে হয়না। সবই ছিল নিরর্থক ও মন্দ কাজ। তা-না হলে ৬ দশকের জীবনের শেষে এসে জীবন এতটা ধূসর ও কষ্টের হবে কেন? বলে রাখা ভালো এই ৬ দশকের জীবনে বুঝতে শেখার পর থেকে সুখে-দুঃখে কত মানুষের সানিধ্য পেয়েছি অথবা দিয়েছি তাদের প্রায় অধিকাংশকে আজ পথে ঘাটে বা কোন আচার-অনুষ্ঠানে দেখা হলে তাদের আচার-আচরণে বা কথাবার্তায় মনে হয় এদের কাউকে আমি কোন কালে দেখিনি বা তারা কেউ আমার কোনকালে পরিচিতই ছিলেন না।

১. ২০১৯ সালে চীন দেশ থেকে উৎপত্তি হয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়া পড়া কোভিড-১৯ মহামারীর প্রর্দূরভাব দেখা দেয়ার প্রাক্কালে বাংলাদেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চে এই ভাইরাস ধরা পড়ে। ঐ সালের এপ্রিল মাসের ২৪ তারিখ একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসাবে এক মহিলার করোনাকালে (কোভিড-১৯) সরকারের দেয়া ত্রাণ না পাওয়ায় ভাত খাওয়ার জন্য চাল চেয়ে আকুতি জানিয়ে এক দীনহীন মহিলার ৩৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিও আমি আমার ব্যক্তিগত ফেইসবুক পেইজে শেয়ার করি। ঐ ভিডিওর সূত্র ধরে ২৮ এপ্রিল আমার বিরুদ্ধে চাঁদপুরের শাহরাস্তি মডেল থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে একটি মামলা করেন এলাকার কমিশনার। এই মামলাটি বর্তমানে সাইবার ট্রাইবুনাল আদালত, চট্টগ্রামে বিচারাধীন রয়েছে। এই মামলায় আমি ১৫ দিন জেল হাজতে ছিলাম বর্তমানে মামলাটি চার্জ গঠনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

০২. নদীমাতৃক আমাদের এই বাংলাদেশ। এই দেশের উপর দিয়ে বয়ে গেছে বহু নদ-নদী। দেশের প্রতিটি অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে গেছে মাকড়সার জালেরমত কোন না কোন নদী। এই নদীগুলো উজান থেকে পানির তোড়ে নিয়ে আসে উর্বর পলি মাটি। আর এই পলি মাটির কারনে এদেশে সোনার ফসল ফলে। এদেশের মাটিতে কোন প্রকার আবাদ ছাড়াই যে কোন ফসলের বীজ বপন করলে সোনার ফসল উৎপন্ন হয়। কৃষি খাতে গত এক দশকের বেশি সময়ে আমুল বিপ্লব সাধিত হয়েছে। ইতিমধ্যে ধান সহ বিভিন্ন ফসলে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে আমাদের এই দেশ। কৃষি খাতে সরকারের এই উন্নয়ন ধারাকে ধরে রাখতে প্রতি বছর সরকার নানামুখী উদ্যোগ গ্রহন করে থাকে। ফলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন জাতের ফসল উৎপন্ন হচ্ছে। অনেক এলাকায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ফলফলাদি উৎপন্ন হচ্ছে। গত কয়েক বছর পূর্বেও এমন অনেক ফলফলাদি বিদেশ থেকে এনে দেশের চাহিদা মিটাতে হতো। আর এখন ঐ ফলফলাদি এ দেশে উৎপন্ন হচ্ছে। যা আমাদের দেশের চাহিদা মিটাতে পারছে। নিকট ভবিষ্যতে আমরা হয়তো তা বিদেশে রফতানি করতে পারবো।

চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার মাঝামাঝি বরাবর বয়ে গেছে ডাকাতিয়া নদী। এই নদীটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে উৎপন্ন হয়ে বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার বাগসারা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এই নদীটি চাঁদপুর ও লক্ষ্ণীপুর জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এই নদীটি চাঁদপুরের শাহরাস্তি উপজেলার অফিস চিতোষী হয়ে শাহরাস্তি উপজেলায় প্রবেশ করে হাজীগঞ্জ উপজেলা হয়ে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনা নদীর মোহনায় মিলিত হয়েছে যা লক্ষ্ণীপুর জেলার হাজীমারা পর্যন্ত বিস্তৃত। ডাকাতিয়া নদীটি কুমিলা, চাঁদপুর ও লক্ষ্ণীপুর জেলার যে অঞ্চল ও জনবসতি এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে তার দুই পাড়ে থাকা ফসলী জমিগুলোতে প্রচুর পরিমান পলি বয়ে নিয়ে এসে কৃষকের জমিতে আরও বেশি ফসল উৎপাদনে সহায়ক হয়েছে। দেশের অন্য জেলার তুলনায় তাই এই অঞ্চলের জনবসতি অনেক বেশি হবার এটা একটি অন্যতম প্রধান কারণ বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করেন।

দীর্ঘদিন বয়ে চলা ডাকাতিয়া নদী স্রোতে বয়ে আনা পলিতে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় বর্তমান সরকার এই মেয়াদে তা খননের উদ্যোগ গ্রহন করেন। কিন্তু নদী খনন কাজে দায়ীত্ব প্রাপ্তরা বছরের পর বছর খনন কাজে কাল ক্ষেপন করায় এক শ্রেণির দূর্বৃত্ত তাদের অনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করতে গিয়ে শাহরাস্তি উপজেলায় ডাকাতিয়া নদীর একই স্থান থেকে মাসের পর মাস ড্রেজিং মেশিন দিয়ে বালু উত্তোলন করায় উপজেলার মাঝদিয়ে বয়ে চলা ডাকাতিয়া নদীর দুইপাড়ের কৃষকের ফসলী জমি ভেঙ্গে নদী গর্ভে তলিয়ে অনেক কৃষক নিঃস-রিক্ত হয়ে পড়ে। এবিষয়ে জাতীয় ও স্থানীয় বহু প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়। একজন সংবাদকর্মী হিসাবে কৃষকের এই ক্ষতির সংবাদ প্রকাশ করায় একটি পক্ষ ক্ষুদ্ধ হয়ে আমার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮ এর বিধান মতে ২০২১ সালের ১৬ মে চাঁদপুরের শাহরাস্তি মডেল থানায় দ্বিতীয় আরও একটি মামলা দায়ের করে। এই মামলায় আমাকে দীর্ঘ একমাস জেল হাজত খাটতে হয়। বর্তমানে এই মামলাটিও চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাইবার ট্রাইবুনাল আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। এই মামলায় আমার সাথে থাকা দ্বিতীয় আসামীকে বিগত ২৭ সেপ্টেম্বর মামলার চার্জ গঠনের তারিখে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে অভিযোগের তালিকা থেকে মাননীয় আদালত তার নাম প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করেন। ঐ তারিখে আমিও অভিযোগ থেকে আমার নাম প্রত্যাহারের আবেদন করি কিন্তু মাননীয় আদালত আমার আবেদন বিবেচনায় নেননি।

মানুষের সুখে-দুঃখে পাশে দাঁড়ানো ছিলো আমার প্রাত্যাহিক জীবনের ধর্ম। কিন্তু আজ এতকাল পরে মনে হচ্ছে জীবনে সুখে-দুঃখে মানুষের পাশে দাঁড়ানোটাই বুঝি অন্যায়। আর বিবেকের তাড়নায় ন্যায্য কথা বলা বা লেখাও বড় পাপ বা অপরাধ। এতকাল পরে আজ নিজের কাছে নিজেকে অনেক ছোট মনে হয়। আনমনে তাই ভাবনার জগতে বারংবার উঁকি দেয় জীবনের ধূসর এই বেলায় মন এত পোড়ে কেন, কেন এত দগ্ধ হই? এর উত্তর কারো জানা আছে?

মোঃ রুহুল আমিন
সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী
e-mail : aminruhul8660@gmail.com

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *